Friday, August 12, 2011

ডাক্তার সাহেবদের কান্ডজ্ঞান-৬

ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাস। আমার পাশের ফ্লাটেই থাকতেন এক সময়। শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। কাজ করেন ঢাকার শিশু হাসপাতালে এবং প্যাক্টিস করেন ওয়াপদা রোডের এক ফার্মাসিতে। ফার্মাসি থেকে আমার বাসা খুব একটা দূরে নয়। কুক দিলে শুনা যাবে। এখন অনেক টাকা পয়সা হয়ে গেছে, মহানগরে বড় বাসায় থাকেন, গাড়ীও কিনেছেন। সন্ধ্যায় ওষধের দোকানের সামনে অনেক শিশু রোগীদের ভীড় দেখি। কামাই করে যাচ্ছেন দুই হাতে বুঝা যায়। এই বাসা ছাড়ার পর অনেক দিন আমার সাথে দেখা হয় না। তার সাথে আমার কোন কাজও নেই দেখা হয়েই বা কি হবে! বছর দুয়েক আগে সেই যে তিনি মহানগরে চলে গেছেন আর এই বাড়ীতে এসেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ সাতেক বড় হলেও কত বেলা, কত দাওয়াত, কত সময় আমি, আমাদের বাড়ীওয়ালা ও ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাস কাটিয়েছি! 

পানে আসক্ত থাকলেও তিনি তার ওয়াইফের ভয়ে এই পথে খুব একটা হাটতেন না। ডাক্তার হিসাবে তাকে আমার কাছে কখনোই ভাল মনে হত না। (পাশাপাশি থাকা স্বত্তেও আমার ছেলেকে তার কাছে কখনো দেখাইনি, ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে রিক্সা ভাড়া গুনেছি তার পরো কখনো তাকে দেখাইনি।) একটু পেটে পড়লে তিনি নানান কথা বলতেন, তাতে আমার কাছে তাকে অনেক আগে থেকেই একজন অমানবীক লোক/ ডাক্তার মনে হত। পরে তার প্রসঙ্গে অনেক জানতে পারি। মেয়ে মেয়েদের আলাপে তার পরিবারের অনেক কথা পরে জেনেছি। তিনি এক গরীব/গৃহস্ত পরিবার থেকে ডাক্তার হয়েছেন, তার মা এখনও গ্রামে থাকেন (আগামী ব্লগে এই প্রসঙ্গে লিখব) ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি ব্লগে লিখি নানা বিষয় নিয়ে। ডাক্তার সাহেবদের নিয়ে আমি কিছু লিখছি এটা আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে গোপন করে যাচ্ছি বা কখনো বলি নাই। গত রাতে আমার স্ত্রী এই ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাস নিয়ে যে ঘটনা শুনালেন তাতে আমি তাজ্জব হয়ে গিয়েছি। ব্লগে না লিখে পারলাম না। তাকে ডাক্তার বলি কি করে! 

আমার স্ত্রী ও পাশের বাসার দুই মহিলা আছরের নামাজের কিছু আগে রামপুরা মার্কেটের দিকে যাচ্ছিলেন, ঈদের কেনা কাটার জন্য। ঠিক আমাদের বাসার সামনে গলি দিয়ে বের হতেই ওয়াপদা রোডে ভীড় দেখে এই তিন মহিলা এগিয়ে যান এবং গিয়ে দেখেন একজন গ্রামীন মহিলা রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, পাশে দুইটা ছোট ফুটফুটে ছেলে ৩ ও ৫ বছরের (হবে হয়ত) কাঁদছে। বাচ্চা দুটো দেখে আমার স্ত্রী মায়ায় পড়ে যান এবং তাকে সাহায্য করার জন্য পথ খুঁজেন। আমার স্ত্রী এই সব পরিস্থিতে পিছপা হন না এবং তার এই ধরনের সাহায্যের মানষিকতা আমি আগেও দেখেছি অনেকবার। আমার স্ত্রী অন্য দুই মহিলা নিয়ে এবং উক্ত মহিলাকে ধরাধরি করে ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাসে চোম্বারে নিয়ে যান। ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাস তখন রোগী দেখছিলেন, আমার স্ত্রীর ধারনা ছিল ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাস যেহেতু তার পরিচিত এবং অবশ্যই তার কথা শুনে উক্ত মহিলাকে অজ্ঞান অবস্থা থেকে ভাল হবার উপায় বাতলে দেবেন।

কিন্তু আমার স্ত্রী ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাসের কাছে উক্ত মহিলাকে নিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন ডাক্তার কাকে বলে! ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাস প্রথমেই উক্ত রোগী দেখে নাক উঁচিয়ে বলেন, কেন একে নিয়ে আসছেন (রোগী গরীব বলেই হয়ত তার এই তাছিল্য, হয়ত টাকা পাবেন না বলে তার এই তাছিল্য)। আমার স্ত্রী বলেন বিশ্বাস দা, ওনার চিকিৎসা করুন যা টাকা, ওষধ পত্র লাগে আমি দেব। এতেও তিনি উক্ত রোগীকে চিকিৎসা করার বিন্দু মাত্র আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই। কোন রকমে পালস দেখে বলে দিলেন, নিয়ে যান ভাল হয়ে যাবে। তার পর এই তিন মহিলা সহ আরো অন্যান্যরা মিলে উক্ত মহিলাকে বাইরে নিয়ে এসে মুখে পানি দিয়ে চামুচ দিয়ে দাঁত ফাঁকা করে, নিজেরা বুদ্দি দিয়ে খাবার স্যালাইন খাইয়ে প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে মহিলাকে সুস্থ্য করে তুলেন। কিছুটা সুস্থ্য হতেই বাসা থেকে ডিম ভাজি সহ তরকারী নিয়ে মহিলাকে ভাত খেতে দেন এবং তার ছেলেদের দেখে রাখেন। এর এক পর্যায়ে মহিলা পুরা পুরি সুস্থ্য হলে সবাই জানতে পারেন, মহিলার করুন ঘটনা।

মহিলা তার স্বামীকে খুজতে বাচ্চা দুটি নিয়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকার রামপুরা এসেছেন আজ সকালে। গত দুইদিন ধরে কিছু না খাওয়াতে এখানে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলেন। স্বামীর পুনাংগ ঠিকানা না জানাতে বাসাও খুঁজে বের করতে পারছিলেন না। স্বামী মাস খানেক আগে বাড়ী থেকে এসেছে, আর যোগাযোগ নাই তাই বাচ্চা দুটো নিয়ে তার খুজতে বের হওয়া। স্বামী নাকি বলেছিলেন, রামপুরায় এসে তার নাম বলেই তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। এত বড় রামপুরায় এ ভাবে কি কাউকে বের করা যায়! হায় রে, কোপাল।

যাই হোক পরে কথা হল মহিলাকে পুরাপারি খাইয়ে ও কাপড় চোপড় (আমার পাশের বাসায় অন্য একজন মহিলা কাপড় দিয়েছেন) দিয়ে, অনেকের কাছ থেকে টাকা কড়ি তুলে (প্রায় দেড় হাজার টাকা) মহিলাকে আবার কুমিল্লা চলে যেতে তারা সবাই সাহায্য করলেন। (চরম এই বোকা মহিলার কপালে আরো কি কি দুর্গতি আছে/ঘটেছিল আল্লাহ জানেন)। যাক এই মহিলা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়।

বিবেচ্য বিষয় হল একজন মানুষ যখন অসুস্থ্য হয়ে পড়ে তাকে কে বেশী সাহায্য করবেন। কার বেশী কর্তব্য একজন অসুস্থ্য রোগীকে সুস্থ্য করে তোলার। অবশ্যই যদি পাশে একজন ডাক্তার থাকেন তার। আমার স্ত্রী এই বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কিছুতেই ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাসের চোখ, মুখ ও অভিবক্তির কথা ভুলতে পারছিলেন না। আমার কাছে তার প্রশ্ন ছিল, একজন ডাক্তার কি করে এতটা অমানুষ হতে পারে। ছোট ছোট বাচ্চা দুটো দেখেও কি করে একজন ডাক্তার চিকিৎসা না করে রোগীকে বের করে দিতে পারে। ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাসকে চরম ভাবে গালী গালাজ করে যাচ্ছিলেন আমার স্ত্রী, অভিশাপ ও দিচ্ছিলেন।

আমি চুপ করে থাকি। এই রকম অনেক অনেক নিষ্ঠুর ডাক্তার নিয়েই যে আমি প্রতিদিন পথ চলি। পাশাপাশি থেকেও তাকে সেই সব কথা বলা হয়নি! বলতে ইচ্ছাও হয় না!

* ডাঃ হরে কৃষ্ণ বিশ্বাস নামটা উক্ত ডাক্তাররের সঠিক নাম নয়। কিছু মিল রেখে নামটা আমি দিয়েছি। আগামী পর্বে তার আর একটা নিষ্ঠুর দিকের কথা লিখব।

ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড: , ,
লেখাটি দুটো ব্লগে এক সাথে প্রকাশ করছি। বিডি ব্লগ ও শব্দনীড়ে।  

Tuesday, August 9, 2011

ডাক্তার সাহেবদের কান্ডজ্ঞান ৫

আমার সাধারন কান্ডজ্ঞানে যা ধরে তা হচ্ছে, কিছু পেশা আছে যাতে আপনাকে যেতেই হবে জেনে শুনে। আপনি জানবেন, আপনি টাকা পাবেন না, সন্মান পাবেন না, কাজ করতে হবে রাতদিন, মেঘ বদলা মথায় নিয়ে। আপনি তবু কাজ করবেন সত্যের পথে, মানবতার পক্ষে, মানব সেবার জন্য। ব্যস, এর কোন বিকল্প নেই এবং এই ধরনের পেশার উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে ডাক্তারী পেশা, শিক্ষকতা পেশা, সংবাদিকতা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই সকল পেশা আমাদের দেশে এখন এতটাই টাকা সর্বস্ব হয়ে গেছে যে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। ডাক্তারদের নিয়ে কাজ করি বলে হয়ত ডাক্তারদের টাকা নেবার রুপটা আমার চোখে বেশী পড়ে!

হাসপাতাল ও ডায়গনাষ্টিকস পরিচালনায় আমাদের সাথে আছে নানা কিছিমের, নানা শর্তের ডাক্তারগন। দিনে তিন ঘণ্টার কন্টাক থেকে বার ঘন্টার ডাক্তারও আমাদের আছে! বেতন নাই (এরা শুধু আমাদের জায়গা ব্যবহার করে থাকে) থেকে আবার পাঁচ লক্ষ টাকা বেতনো আছে। কিছু ডাক্তার শুধু চেম্বার করেন, রোগীর বাকী দ্বায়ীত্ব আমাদের। এত নানা কিছিম, এত নানা শর্ত ডাক্তার সাহেবরাই আমাদের দিয়েছেন। ওনাদের ধরে রাখতে আমাদের জান প্রান যায় অবস্থা, আমরা ওনাদের কথা মতই চলি। হাসপাতাল ও ডায়গনাষ্টিকস পরিচালনায় প্রথম ভগবান বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগন, দ্বিতীয় ভগবান ধনী জটিল রোগধারী রোগী ও রোগিণীগন! কথাটা বাজে শুনালেও একশত ভাগ সত্য। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগন দেখে রোগী আসে, আমাদের কাছে টেষ্ট করে, ভর্তি হয়ে হাসপাতালের সেবা গ্রহন করে (রোগী ভাল হন কিংবা মরে যান) – আমরা টাকা পাই।

যাই হোক, হাসপাতাল ও ডায়গনাষ্টিকস নিয়ে আজ নয়। এই সিরিজে শুধু ডাক্তার সাহেবদের কান্ডজ্ঞান নিয়েই আলোচনা চলবে। প্রতিদিন দুইবেলা করে আমি নানা ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে দিয়ে হেঁটে বেড়াই। এটা আমার কাজের ও দ্বায়িত্বের অংশ। আমি ডাক্তার সাহেবদের সামনে বসা সহকারীদের সাথে কথা বলি, তারা ঠিক সময়ে আসল কিনা, সিরিয়াল রাখল কি না, তিনি কত রোগী দেখেছেন, ডাক্তার সাহেব কেমন আছেন ইত্যাদি ইত্যাদি জানতে চাই। সমস্যা হলে সমাধান করি। মাঝে মাঝে ডাক্তার সাহেবদের সাথেও কথা বলি। সালাম দেই, কেউ কেউ অনেক ভদ্র। সালামের জবার দিয়ে আমার ও আমার প্রতিষ্ঠানের মালিকের খোঁজ নেন আবার কেউ কেউ এমন ভাব মারেন যেন তিনি আমার ও আমার প্রতিষ্ঠানের মালিকে দয়া করছেন! আমি হাসি।
এই সিরিজ চালু করার পর থেকে অনেক দিন ধরে এটা লিখব বলে ভাবছিলাম। আমি প্রায় প্রতি নিয়ত এক জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। তিনি সরকারী চাকুরী করেন, আমাদের এখানে সন্ধ্যার পর বসেন। রাত ১/২ টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। ঠিক তার কক্ষের দরজার মধ্য খানে বড় করে একটা নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়া আছে। আমি কত হাজার বার পড়েছি তার ইয়েতা নেই! আপনি এখানে আসলে, বাংলা পড়া জানলে (!) আপনিও কয়েকবার পড়ে যাবেন। আমি নিশ্চিত। গাট্টা গাট্রা বর্ণে পরিস্কার লেখা কিছু পয়েন্ট।

১। নূতন রোগীদের জন্য ডাক্তার ফী ৬০০/- টাকা
২। পুরাতন রোগীদের জন্য ডাক্তার ফী ৪০০/- টাকা
৩। রিপোর্ট দেখানো প্রতি বার ২০০/- টাকা
৪। দুইমাস পরে পুরাতন রোগীরা নূতন রোগী হয়ে যাবেন।
৫। রোগী দেখানোর জন্য সকাল ৭ টায় সরাসরি এসে সিরিয়াল দিয়ে যেতে হবে।
৬। নূতন রোগীদের হিষ্ট্রি রাত ১০টার পর লিখা হয়।

লেখাটা আমার প্রায় মুখস্ত। দিনে তিনি ৭০/৮০ জন রোগী দেখেন, নূতন পুরাতন মিলিয়ে। ফাঁকে ফাঁকে চলে রিপোর্ট দেখা। সম্প্রতি তিনি ভাবছেন, আর এভাবে চলছে না , আবার ফী বাড়াতে হবে! এত কষ্টে এত কম টাকায় হয়ত আর চলছে না!

(এই সিরিজটা বিডি ব্লগে প্রথম প্রকাশ করব ভাবছি, কিন্তু মডারেট ব্লগ হয়াতে সেই মজা পাই না।)